বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১০

সিক লিভ

তাহের সাহেব তথা তাহের কবির , এই ব্যস্ত শহরেরই আর দশজন লোকের মতই খেটে খাওয়া মানুষ | একটা কোম্পানিতে মোটামুটি বেতনের চাকরিতে তার সময় ভালই কাটে, বারতি আয়ের জন্য শেয়ার ব্যবসাটা রপ্ত করেছেন | একা থাকেন একটা মেসবাড়িতে, এখনো সংসারী হননি, সংসারী হওয়ার ব্যাপারটা বাবা মার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো থাকেন | এই শহরে তার একটাই বিরক্তি - তার মেস থেকে অফিসপাড়া  মোটামুটি ভালই দুরে | বাসে যাতায়াত তার প্রথম পছন্দ , দু এক বার মোটরসাইকেল কেনার কথা মাথায় উকি দিলেও , আলসেমি করে এই ধান্দা বাদ দিয়েছেন | বন্ধুও খুব বেশি নেই , তাই রোজ আড্ডা না দিলেও তার দিন চলে যায়, ইদানিং ব্রোকার হাউজেও যেতে হয়না শেয়ার ট্রেডিং অফিসে বসেই করেন | এই ভাবে ভালই চলছিলো, বিপত্তি বাধলো গতকাল থেকে|
গতকাল রাত থেকে তাহেরের বাম পায়ের অবস্থা ভালোনা  | মনে মনে তিনি হাজারটা গালি দিছেন নিজেকে , কেনযে বাসে ওই মহিলাকে সিট অফার করলেন, হাই হিলের পারা যে এমন বিষফোড়ার মতো , তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, পেইন কিলারটাকেও ভেজাল মনে হচ্ছে, ব্যথা সাড়ার নামই নিচ্ছেনা | মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন , আর কখনো মহিলাদের সিট ছেড়ে দেবেননা | হাই হিল পরে কেউ বসে ওঠে ?! 


ভালয় ভালয় অফিস আসলেন | এসে আবিস্কার করলেন তার আর দিনার টেবিলের মাঝখানে যুলানো বাল্বটা নষ্ট | ডানের টেবিলটা দিনা জাহানের |  দিনা তাহেরের কলিগ, ধোপ দূরস্থ, পরিপাটি , চটপটে মহিলা |
উনার অফিসটা সরকারী অফিসের মতো- সারি সারি টেবিল সাজানো | তার টেবিলের বাম পাশে তাই গ্লাসে পার্টিশন করা সাফায়েত এর কামরা | সাফায়েত মুকিম , তাহেরের বস |  অফিসে  ঢুকে প্রতিদিন তাহেরের প্রথম কথা হয় দিনার সাথে | আজ কথা বলা তো দুরে থাক, কাজেও অনিহা লাগছে | দিনা তাহেরের মেজাজের অবস্থা বুঝতে পারলো, তাহেরের কেন মন খারাপ তাহের দিনাকে বললেন | তাহের হালকা বোধ করতে লাগলেন | মনে হয় খারাপ সময়টা শেষ হতে যাচ্ছে, কিন্তু পায়ের ব্যথাতো যাচ্ছে না | 
তাহের ছুটি নেওয়ার চিন্তা শুরু করলেন , আবার মনে হতো লাগলো অনেক কাজ পরে আছে , কাজ নাথাকলেও সময় কাটানোর জন্য হলেও  অফিসে থাকা চাই ; অন্তত নিজের পিসিটা থেকে শেয়ার উঠানামা তো দেখা যাবে, বাসায় তো ইন্টারনেট সংযোগ নেই | তাহের দ্বিধায় পরে গেলেন | তাছাড়া সাফায়েত এই ফিসকাল ক্লোজিং এর সময় ছুটি দিবেননা | ছুটির চিন্তা তাই মুহুর্তেই মাথা থেকে উড়ে গেলো| কোনমতে প্রথম ঘন্টা পার হয়ে গেলো, এর পরেই এলো সেই নোটিশ-
"ইদানিং কর্মচারীদের মধ্যে ফেসবুক ও শেয়ার বাজারের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ পরিলক্ষিত হছে, বিধায় কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রমে মন্থর গতিতে চলছে | এমত অবস্থায়, সবার পিসি থেকে ইন্ট্রানেট ব্যতীত ইন্টারনেট সংযোগ বিছিন্ন করা হইলো"

নাহ ! আর থাকা গেলো না ! অফিসের প্রতি যে কাজের তাগিদ তাহের অনুভব করেন , তাও নাই হতে চললো, এইবার তাহের ছুটির জন্য পাগল হয়ে গেলেন | কি করা যায় ? বসকে গিয়ে পায়ে ব্যথার কথা বলবেন , নাকি অন্য কোনো ব্যস্থা নিবেন ? পায়ে পট্টি বাধা থাকলে, বসের সহানুভূতি পাওয়া যেত , কিন্তু পায়ে তো পট্টি নেই | অন্য কোনো উপায় ! মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, কিন্তু বেশি পাগলামি আর ছেলেমানুষী আইডিয়া..
যা আছে কপালে ভেবে, তাহের দুই টেবিলের মাঝে ঝুলানো বাল্ব হোল্ডারটা ধরে ঝুলে গেলেন, আর বাদরের মতো শব্দতো আছেই | সবাই হতভম্ব ! সবচেয়ে  বেশি  অবাক হলেন দিনা, কখনো তার কলিগকে এমন পাগলাটে অবস্থায় দেখেননি| বিস্ময়ে তার হাতের কলমটা নিচে পরে গেলো | তাহের পাগল হয়ে গিয়েছেন , এমন একটা রব উঠলো | তাহের রসিক লোক নন , তাই কেউ তাহেরের এমন আচরণকে রসিকতা হিসেবে নিতে পারছেন না | দিনা তাহেরকে সামলানোর জন্য জিজ্ঞেস করলেন- "তাহের ভাই, কি হয়েছে আপনার ? নিচে নেমে আসুন "| "না , নিচে নামবো না, দেখছেন না-  আমি এখন বাল্ব হয়েছি "- তাহেরের পাল্টা উত্তর | সবাই তাহেরের কাছে জড়ো হয়ে গেলো , কিন্তু তাহেরকে নামানো যাচ্ছেনা | 


গ্লাস পার্টিশনের ওইপাশে এক সাথে অনেক লোকের অবয়ব দেখা যাচ্ছে |হঠাৎ আবার কি ঘটলো ? আজ অফিসে কারো জন্মদিন নাতো?  সাফায়েতের চোখ কম্পিউটারের মনিটরে সরিয়ে নিলেন |  ফেসবুক নাই- এই সামান্য ব্যাপারে এত অসন্তোষ ! এমনটিতো হবার নয় | গ্লাসের ওপাশে লোকজনের অবয়বও বড় হচছে, বদরের ডাকও কানে আসলো | আজকাল কত রকমের মোবাইল রিংটোন শোনা যায়, বাদরের ডাকের রিংটোনও নিশ্চয় আছে|   সাফায়েত এরকম কিছু হলে প্রথমে তাহেরেকে ফোন করে খোজ নেন, ব্রিত্তান্ত জানার জন্য|এইবার তাহেরকে ফোন দিয়ে পেলেন না | নিজের কামরা থেকে বের হয়ে আসলেন, দেখলেন তাহেরের টেবিলের কাছে জটলা | বসকে দেখে সবাই নিজেকে সামলে নিলেন | বসকে দেখে সবাই চুপ| কিন্তু তাহের আজ নাছোড় কর্মী, তিনি পায়েব্যথা নিয়েই লটকে রইলেন | "কি ব্যাপার তাহের সাহেব ? বানরের মতো ঝুলে আছেন কেন ? ", "স্যার, আমি বাল্ব হয়ে গেছি, সবাইকে আলো দিচ্ছি"- তাহের বললো | সাফায়েত তাহেরকে এইরকম পাগলামি করতে দেখে হচকচিয়ে গেলেন| তাহেরের নামে মানব সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদনে শান্ত প্রকৃতির কথা লিখা | সাফায়েত দ্রুত স্বিধান্ত নিলেন, এই পাগলামি অফিসে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া যাবেনা|   সাফায়েত চারপাশে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেন | সবাই যে যার টেবিলে চলে গেছে , শুধু দিনা আর তিনি তাহেরের সামনে দাড়িয়ে | তাহেরের উদ্দ্যেশ্যে বললেন-
"বুঝেছি , টানা অনেকদিন কাজ করে আপনি পাগল হয়ে গেছেন, এই মুহুর্তে অফিস ত্যাগ করেন , দুই দিন পর মাথা ঠিক করে তারপর কাজে যোগ্ দিন" | তাহের বাম পা সামলে নিচে নামলেন | সাফায়েত সাহেব তার কামরায় চলে গেলেন | তাহের মনে মনে অনেক খুশি , অনেক বড় একটা কাজ করে ফেলেছেন , এই চিন্তা করে আটখান হয়ে গেলেন |


অফিস থেকে তাহের বাইরে এসে দাড়িয়ে , খুশিতে লাফ দিতে ইচ্ছে করছে তার, পায়ের ব্যথার জন্য এই চিন্তা বাদ দিলেন | ছুটি পেয়ে গেছেন | এই আনন্দে এক কাপ চা খাওয়া যায় , অফিসের পাশের টং দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিলেন, এমন সময় পেছন থেকে ঘাড়ে টোকা পরলো, আরে এত দিনা ! 
দিনা দেখে তাহের অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন  "দিনা , আপনি ?"
দিনা হাসিমুখে উত্তর দিলেন- 
"আমি অন্ধকারে কাজ করতে পারবনা , তাই আমারও ছুটি "
---
একই সাথে নাগরিকে প্রকাশিত | 

কোন মন্তব্য নেই: