সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

প্রিয় বর্ষা, প্রিয় বৃষ্টি

আমার শৈশবের সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল প্রতিদিন বিকাল বেলা আছরের আজান দেওয়ার সাথে সাথে গায়ে কোনরকমে জামা চাপিয়ে প্রায়ই খালি পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম মাঠের দিকে।আছর থেকে মাগরিবের ওয়াক্ত পর্যন্ত সময়টা আমার আর আমার মতো শিশুদের জন্য। আমার ধারনা আমার মতো অনেকেই আছেন যারা প্রতিদিনই বিকালের এই সময়টার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন কখন আজান পরবে,মাইকে আজান শোনার সাথে সাথে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া প্রতিদিন বৃষ্টির জন্য বর্ষাকাল ছিল আরো আনন্দের। প্রাইমারি-তে আমরা বাংলা পাঠ্য হিসেবে “আমার বই” পড়তাম, সেই বইয়ে হাশেম খানের আঁকা বর্ষাঋতুর ছবির সাথে আমাদের ছেলেবেলার ‘বাস্তব’ বর্ষার অনেক মিল ছিল।এখন জলবায়ু পরিবর্তনের এইযুগে, জুন মাসের শেষ সপ্তাহ এলেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে না।বর্ষা কালে বিকালে বৃষ্টি হোক বা না হোক, স্কুলের মাঠের কাদায় দাপাদাপি, প্যাচ প্যাঁচে কাদায় ফুটবল খেলা পুকুরে ডুবে থাকা, জামায় লাল মাটির দাগ লাগানো ছিল আমাদের স্বাভাবিক খেলার রুটিনের বাইরে বাধাহীন আনন্দের উৎস। ভাবতে ভাল লাগে, আমার বাবা-মা এই কাদা আর বৃষ্টির উৎসবে কখনো বাধা দেননি। ভিজে ঠান্ডা না লাগানো পর্যন্ত আমার গালমন্দ শুনতে হতোনা। আমি ছাতা মাথায় দেওয়ার ব্যাপারে আনাড়ী বা বেখেয়াল ছিলাম কারণ ছাতাটা হারিয়ে যেত নয়তো স্কুল ব্যাগে পরে থাকতো। আমার সহপাঠি অথবা এলাকার সমবয়েসিদের মাঝে হাতে গোনা দু-এক জন ছাড়া রেইন কোটের ব্যবহার আমরা করতাম না। বর্ষায় ভেজা আমাদের জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল শেষ বিকালের রংধনু আমার চোখে আনেক বার ধরা দিয়েছে।সম্পুর্ন দিগন্তজোড়া রঙধনু আমি অনেকবার দেখেছি।
বর্তমানে আমি ঢাকার এক আবাসন প্রকল্পে থাকি যেথায় আমার ফ্ল্যাটের চারপাশে অনেক বাড়ী। আশে আশে পাশে বড় কোন খোলা মাঠ বা প্রান্তর নেই। আমার বাসার সামনে রাস্তা পেলে স্কুল।প্রতিদিন সকালে ছোট বাচ্চাদের ঘুম জড়ানো কন্ঠে গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত আর ক্লাস শুরুর ঘন্টার শব্দে আমার তন্দ্রা ভাঙ্গে।সপ্তাহের শনিবার আমার অফিস নেই। এইদিনে বারান্দা থেকে, স্কুলে টিফিন পিরিয়ডের সময় স্কুলের ছোট ঘাসহীন মাঠে বাচ্চাদের ছুটাছুটি করতে দেখি। ঐ মাঠটা আদতে আমার জন্য ছোট, কিন্তু ঐ বাচ্চাদের জন্য অনেক কিছু, এদের কাছে এটাই অনেক বড়।এই প্রাইমারি পড়ুয়া শিশুদের কাছে স্কুলের মাঠের বাইরে বলতে বোঝায়, দুই/তিন বাড়ীর মাঝে পরে থাকা ফাকা প্লট। এই ফাকা প্লটগুলি অনেক কৃত্রিম, এখানে অন্য প্লটের বাড়ী তৈরীর সরঞ্জাম থাকে, সাথে থাকে অনেক স্ক্র্যাপ । বর্ষাকালে, তিন দেয়ালের মাঝে আটকে পরা জায়গায় দাপাদাপি করার মতো পানি জমে না। ঘনবসতি আর প্রতিযোগিতার এই শহরে অনেক শিশুর বিকাল বেলা কেটে যায় গলিতে বা বাসার ছাদে দৌড়াদৌড়ি করে, টেলিভিশনে Ben Ten দেখে, নয়তো কোচিং সেন্টারে  রাফ খাতায় কাটা কুটি করে। আমাদের শিশুরা শৈশবে যান্ত্রিকতায় অভ্যস্থ হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করার ইচ্ছা নিশ্চই তাদের মনে জাগে। আমি জানি, আমাদের বাচ্চাদের DNAতে ‘বৃষ্টি আর বর্ষাকালের সাথে সখ্যতা’-দুটোই সুপ্ত রয়েছে, সুযোগ বা পরিবেশ পেলে বৃষ্টি আর বর্ষার আনন্দ তাদেরও স্পর্শ করে। আমাদের দেশে, সরকারী ঠিকাদারদের বাজে অভ্যাস আছে- রাস্তা মেরামত, সুয়ারেজ লাইন বসানো থেকে শুরু করে। যাবতীয় খোড়াখোড়ি বৃষ্টির মৌসুম এলে শুরু করেন। ভালো বা মন্দ- রাস্তা যেমনি হোক উন্নয়নের নামে রাস্তার উপর বার্ষিক অপারেশন শুরু হয়ে যায়। খানা-খন্দ ভর্তি রাস্তা দিয়ে যান-বাহন চালানো অথবা হেটে যাওয়াও বেশ বিড়ম্বনা। অনেক দিন পর এরকম বেশ বড় একটা গর্তের পানিতে বেশ কিছু স্কুল ফেরত বাচ্চাদের খেলতে দেখলাম। এই প্রথম আমি রাস্তা কাটা কাটি করা লোকদের গালি দিলাম না।



আমরা আমাদের শহুরে শিশুদেরজন্য খোলা প্রান্তর বা মাঠের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছি, আমার শৈশবের সে পরিবেশ আমি বা আমরা তাদের জন্য রেখে যেতে পারছিনা; কিন্তু বর্ষাকাল সময় করে প্রতি বছর আসে, তাই বর্ষা মৌসুমের এই পরিবেশ নিয়ে আমাদের আয়োজন থেমে থাকে না। বিকল্প উপায়ে হলেও সংকীর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা বর্ষা কালের আবেগ ধারন করে। মাঠ , ধানক্ষেত বা পুকুর হয়তো আশে পাশে নেই, তাই রাস্তার বড় কাদাপানি ভরা গর্তই বৃষ্টিতে ভেজার সাথে দাপাদাপি করে আনন্দ করার জন্য সবচেয়ে ভাল স্থান। আহ শৈশবের প্রিয় বর্ষা, প্রিয় বৃষ্টি।

২৬.০৮.২০১৩

কোন মন্তব্য নেই: